বাঁশ-ফোঁড়ন

কর্তৃক farukgangni

যদি বলি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন বাঁশময়, তবে খুব একটা অত্যুক্তি হয় না। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় সেই যে বাঁশের চাঁচ দিয়ে নাড়ী কেটে যাত্রা শুরু, শেষ হয় একেবারে মৃত্যু পরবর্তী বাসস্থানে বাঁশ মুড়নো ছাউনির কবর ঘরে। কোনো এক মহান ব্যক্তি বলেছিলেন, বাঙালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। বলতে বাধ্য হচ্ছি ভদ্রলোকের জানাশোনায় ঘাটতি ছিল, নইলে বলতেন, বাঙালি বাঁশ থাকতে বাঁশের মর্যাদা বোঝে না।

চরম অযত্ন এবং অবহেলায় বেড়ে ওঠা একেকটি বাঁশ যেন জীবনের এক একটি অবলম্বন। ঘরের খুঁটি, চালা বাঁধতে, সীমানায় বেড়া দিতে, রাস্তা বা নালার বাঁধ আটকাতে, খাল-জলাশয়ে সাঁকো গড়তে বাঁশ একক এবং অদ্বিতীয়ম। জমিতে লাঙল চষতে, গো-মহিষের গাড়ি জুড়তে, ঘানিতে তৈল ভানতে, নৌকার গলুই আর লগি-বৈঠা তৈরিতে বাঁশের কোনো বিকল্প নেই। লোকে বলে ওপরে উঠতে নাকি গুরু ধরা লাগে, একদম ভুল কথা, ওপরে উঠতে লাগে আসলে বাঁশ! বাঁশের তৈরি মই বেয়ে বেয়েই কেবল ওপরে ওঠা যায়। নিচে নামতেও, অর্থাৎ কুয়োর গভীরে যেতে হলেও বাঁশের অবলম্বন চাই।

বাঁশ শুধু কাজেই লাগানো হয় না, দেশের বিভিন্ন স্থানে এটি মুখরোচক তরকারি হিসেবে রান্না করে খাওয়াও হয়ে থাকে। আমি নিজেও খেয়ে দেখেছি, মন্দ নয়। অবশ্য খেতে ভালো না মন্দ এটি বিষয় না। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, বাঁশ মূলত ঘাস। যদি তা-ই হয়; ছোট ছোট ঘাসে মুখ দিয়ে চলা চতুষ্পদদের যে আমরা ‘গরু’ বা ‘বলদ’ বলে ডাকি, তাহলে যারা বড় বড় ঘাসের স্বাদ আস্বাদন করেছি বা করছি, তারা তবে কী? জাতির বিবেকের কাছে এই প্রশ্নটি তোলা রইল।

‘বাঁশ খাওয়া’ আর ‘বাঁশ দেওয়া’ আমাদের বাঙালি জীবনের প্রধানতম দুটি কাজ। অষ্ট আশির বন্যাকালীন সময়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমি আপনাদের বাঁশ দেব। উনি কী ধরণের বাঁশ দিতে চেয়েছিলেন আর জনসাধারণ কী ধরণের বাঁশ পেয়েছিল তা বলা বাহুল্য। আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে ‘পরিবেশবান্ধব’ শব্দটি হালে প্রচন্ড পানি পেয়েছে। আমাদের সদাশয় প্রকৌশলী ভাইয়েরা সেটির বাস্তবায়নে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। এতদিন নির্মাণ কাজের বাহ্যিক অংশে অর্থাৎ সেন্টারিং-সাটারিং, মাঁচা, অস্থায়ী খুঁটি প্রভৃতিতে বাঁশ ব্যবহার হয়ে আসছিল। উনারা আরেক ধাপ এগিয়ে কংক্রিটের ভেতরে, রেলের স্লিপারে, লিফটের গার্ডারে লৌহের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করে জাতির পশ্চাৎদেশে বাঁশ ঢোকানোর প্রক্রিয়ায় নেমেছেন!

কথায় বলে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়। মানা না মানা ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও আমরা যারা নব্বই দশকের শিক্ষার্থী, তারা হাড়ে হাড়ে জানি কঞ্চি বাঁশের চেয়ে কত বড় হতে পারে! তখনকার সময়ে পাঠদানের মুষ্টিমেয় দু’ একটি উপকরণের মধ্যে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাঁচা কঞ্চি। আর অঙ্কে দুর্বল ছাত্রদের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল ঐ বাঁশ। সেই যে একটি বাঁশে তৈল মাখিয়ে বানরকে ওঠানামা করতে হতো, আর আমাদের সেটি হিসেব কষে বের করতে হতো, এর চেয়ে যাতনাদায়ক আর কী থাকতে পারে! আসলে রাগ হওয়া উচিৎ ছিল ব্যাটা বানরের ওপর, খামোখা তৈল মাখানো বাঁশ বেয়ে ওঠার কী দরকার? কিন্তু পারতাম না, কেননা আমরাও ওই বানর গোত্রের ছিলাম কিনা, নইলে আবার অঙ্কে কাঁচা হব কেন!

অনাদি কাল থেকে আদিবাসি বোনেরা বাঁশের খোলে মাছ-মাংস পুরে মজাদার রান্নার কাজ করে আসছেন। অধুনা সমাজে বাঁশ দিয়ে ফুলদানি, অ্যাস্ট্রে থেকে শুরু করে হরেক ধরণের গৃহস্থালি তৈজসপত্র তৈরি হচ্ছে। সোফা, টেবিল, ওয়ালম্যাট, ট্রলির মতো অনেক প্রয়োজনীয় বিলাস পণ্যও এখন বাঁশ দিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে। সভ্যতা বিনির্মাণের অন্যতম প্রধান উপকরণ হল, কাগজ। সেই কাগজও তৈরি হয় বাঁশ দিয়ে। আমাদের ছেলেবেলার সবচে আকর্ষণীয় জিনিসের একটি ছিল, আইসক্রিম। এখনকার মতো চোঙায় ঢোকানো বা বাক্সে প্যাক করা আইসক্রিম নয়, বরফের মধ্যে বাঁশের কাঠি ঢোকানো আইসিক্রিম! আকাশ সংস্কৃতির আগে, টিভি বিনোদনের অবলম্বন ছিল একমাত্র বাঁশ। টিভি সেট চালুর পরে, মাথায় লটকানো অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে অ্যাডজাস্ট করার জন্য বাঁশ ধরে মুচড়োমুচড়ি করা ছাড়া টিভি দ্যাখার কোনো উপায় ছিল না।

অর্থনীতিতে বাঁশের নিজস্ব একটি অবস্থান রয়েছে। বাঁশ এবং বাঁশজাত পণ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এদেশে একটি সম্প্রদায় আছে, যাঁরা শুধু বাঁশ নিয়েই কারবার করেন অর্থাৎ বাঁশের চাটাই, চাঙারি, মোড়া, কুলো, তকাই, খাঁচা, মাথল, ঠুসি, ঝুড়ি, দোলনা প্রভৃতি বানিয়ে জীবনধারণ করেন। আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রসারের বহু আগেই, আমাদের মা-বোনেরা ঘরের খুঁটির বাঁশ ছেদ করে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আকস্মিক হাত খরচ মেটানোর প্রয়োজনে হুট করে বাড়ির পাশের ঝাড় থেকে দুটো বাঁশ কেটে পকেটস্থ করতে পারে বাড়ির বেকার ছেলেটি।

বাঁশ যে শুধু জীবনের স্থুল প্রয়োজন মেটায়, তা নয়। হৃদয়ের জ্বালা মেটাতেও বাঁশের জুড়ি নেই। রাঁধা-কৃষ্ণের অমর প্রেমগাঁথা কে না জানে? তার মূলেও এই বাঁশ, মানে বাঁশের বাঁশি আর কি! ক্লান্ত দুপুরে বা বিষণ্ণ বিকেলে মন শান্ত করতে বাঁশের বাঁশির মিষ্টি সুর টনিকের মতো কাজ করে। মাদল বা একতারার মতো বাদ্যযন্ত্র বানাতেও বাঁশ প্রয়োজন হয়। উত্তর প্রদেশের একটি গ্রামে দেখলাম, নারীর ভূষণ শাড়ি তৈরি হচ্ছে বাঁশের তন্তু দিয়ে। আর চাইনিজদের কথা তো বলিহারি, বাঁশকে তারা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। তারা এখন বাঁশ দিয়ে বালিশ, বোর্ড, কফিনসহ নানা ধরণের পণ্য উৎপাদন করছে।

কেবল জীবনধারণ নয়, জীবন হরণ এবং মারামারি গুঁতোগুঁতির জন্যও আমাদের বাঁশ প্রয়োজন হয়। সাইয়েদ নেসার আলী তিতুমীর নামে এক বীর, বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলের অদম্য জোয়ানরা বাঁশের তৈরি টেঁটা নামক অস্ত্র নিয়ে এখনো সম্মুখ সমরে বীরের মতো মারামারি করে। দুঃখের বিষয় দেশের ঐতিহ্য ধরে রাখা এই বীর বাহাদুর ছেলেগুলোকে এখন পর্যন্ত কেউ সম্মাননায় ভূষিত করল না! ছেলেবেলায় আমরা বাঁশ দিয়ে বন্দুক বানিয়েছি, প্রাণঘাতী না হলেও ছোটখাট ‘বাঁশ’ দিতে বাঁশের বন্দুক যথেষ্ট ছিল। পুলিশের হাতের বাঁশের কথা আজ না হয় বাদ থাক।

একে অন্যকে ‘বাঁশ’ দেওয়া-নেওয়া বাদ দিয়ে যদি আমরা বাঁশের মতো হতাম, তাহলে সমাজটা বেঁচে যেত। একইসঙ্গে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান যোগান দিয়ে যাওয়া যে বাঁশ, অমিত শক্তিশালী কিন্ত প্রয়োজনের সময় যথেষ্ট নমনীয় (flexible), মানুষের জন্য যথেষ্ট অনুকরণীয় হতে পারে। কেবল একটি বিষয় মনে রাখতে হবে সময়ের কাজ সময়ে করার ব্যাপারে, যেটি গুণীজনেরা বহু আগেই সাবধান করে গেছেন; কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে টাস টাস। এম এম জাকির হোসেন প্রকৌশলী, ত্রাণ শাখা zakirkhalid776@gmail.com

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন

shares
error: Content is protected !!